স্মৃতিকথা

টিমটিমে আলোর ঝিমঝিম শহর- আতা সরকার

সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে ঘরে। কড়া হুকুম।
স্কুলবালক আমাদের গার্জিয়ানের হুকুম মান্য না করে উপায় নেই।
পাখির মতো ডানা ঝাপটে খেলার মাঠ থেকে ঘরে ফিরতে গিয়েই দেখা পেতাম ওদের। রাস্তার পাশে কিছু দূর দূর ল্যাম্পপোস্ট। ওরা মই বেয়ে উঠছে। কাঁচের ঢাকনা খুলে চিমনি বের করে পরিষ্কার করছে। কেরোসিন ভরছে। ম্যাচ ঠুকে বাতি জ্বালাচ্ছে। রাতভর এই বাতিগুলোই টিমটিমে আলোয় শহর পাহারা দেয়।
সকালে এই লোকগুলোই আবার কখন এসে বাতি নিভিয়ে যায়, দেখার বড়ো সাধ। তা আর দেখা হয়নি। শুকতারা-ভোরে উঠে বকুল ফুল কুড়োতে যাওয়ার সময়ও দেখি বাতিগুলো জ্বলছে। তখনো কোনো লোক আসেনি। ফুল নিয়ে ফেরার সময় দেখি, বাতি নেভানো। লোককে আর দেখতে পাই না। বন্ধুদের কেউ কেউ বলে, পরিমাণমতো কেরোসিন ভরে যায়। সকাল হতেই তেল ফুরিয়ে বাতি আপনাআপনি নিভে যায়।
কে জানে!
[ ]
আমাদের শহর জামালপুরে তখনো বিজলি আসেনি। আমার শৈশবে। বাল্যে। না রাস্তায়। না ঘরবাড়িতে। না দোকানপাটে। সিনেমা হলগুলোতে জেনারেটর চলে। আশরা বলি ডায়নামো। তাই চলে ছবি বেশ খানিক আগে থেকে। তার গুরুগম্ভীর আওয়াজের সাথে জ্বলে বিজলী বাতি, চলে ফ্যান, বাজে উচ্চগ্রামে গান, চলে সিনেমা। এ ছাড়া আর সব জায়গায় টিমটিম আলো। ভূতুড়ে ভূতুড়ে লাগে।
আমাদের সেসময়কার সন্ধ্যে আর রাত কেটেছে হ্যারিকেনের মিটিমিটি আলোয়। রান্নাঘর গরম করে তুলেছে চুলোর খড়ি কাঠের আগুন আর ঘরের ভেতরটা দৃশ্যমান করে তুলেছে কেরোসিনের কাঁপা কাঁপা আলো।
আমাদের চোখে স্বপ্ন ঘনিয়েছে ঝিঁঝিঁ পোকার টানা গান শুনে। আর এর সাথে জোনাকদের এই জ্বলা এই নেভার খেলায়।
আকাশের শুক্ল পক্ষের চাঁদ শহরের ল্যাম্পপোস্টের আলোর সাথে লুকোচুরি খেলে খেলে রাতকে কাবার করে দেয়। আর পূর্ণিমা তো জগত ভাসিয়ে নেয়। আকাশের তারাগুলোর কানাকানি মেঘদলের সাথে লুকোছাপা রাতের ভেতরে নিয়ে আসে অনাবিল রহস্যময়তা।
‌[ ]
আমরা পড়াশুনো করি হ্যারিকেনের আলোয়। দোকানপাটে হ্যাজাক বাতিও জ্বলে। শহরে রাতে কোনো অনুষ্ঠান নাটক বিচিত্রানুষ্ঠান সভাসমাবেশ মাহফিল মেলা যাত্রা হলেও আলোর ভরসা হ্যাজাক। আরো বড়ো কোনো প্রোগ্রাম হলে জেনারেটর আমদানি হয়।
মসজিদে লোকজন মোমবাতি দান করে। ধর্মীয় যে কোনো কাজে মসজিদে মোম দেয়াও একটা কর্ম।
ধর্মীয় উৎসবে বিশেষ করে শবে বরাতের রাতে আমরা বাড়ির আঙিনা আলোকিত করতাম সারিবদ্ধ মোম সাজিয়ে।
সেসময় আমরা যে বাসায় থাকতাম, আমাদের বাসার সামনে খোলা ক্ষেতখামার। বহুদূর পর্যন্ত খালি চোখে দেখা যায়। ওপ্রান্তে রেললাইন। তার হুঁইসেল ঝিকঝিক যেমন শোনা যায়, চলমান চেহারাটাও দেখা যায়। দেখা যায় কলেজের নতুন পুকুরটাও। ওদিকেই কবরখানা। রাতের গা ছমছম অন্ধকারে ওপানে তাকালে কখনো কখনো আগুন জ্বলে উঠতে দেখা যায়। মনে হয় যেন কোনো কবর থেকে উঠে যাচ্ছে আসমানে। ওটা কি মৃতের আত্মা?
কেউ বলে ভূতের নাচন। কেউ বলে জ্বীন যায় উড়ে। কেউ বলে আলেয়ার খেলা। আরেকটু পরে উপরের ক্লাসে যখন বিজ্ঞান বই পড়তে হলো, তখন পেয়ে যাই এর ব্যাখ্যা।
[ ]
জামালপুরে একটাই প্রধান সড়ক। স্টেশন টু পাথালিয়া। সেখান থেকেই গলি উপগলি গিয়েছে শহরের এপাড়ায় ওপাড়ায়। পাকা রাস্তা নয়। ইট বিছানো। না হয় খোয়া বালির মিশেলে।
প্রধান বাহন রিকসা। এসডিও আর এসডিপিও সাহেবের জিপগাড়ি। মালপত্র নিয়ে ট্রাকও আসে। আসে গরুর গাড়িও।
একদিন মেইন রোড পাকা করার কাজ শুরু হলো।
পৌরসভার উদ্যোগে বিদ্যুতও এলো। রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টগুলো লাইটপোস্টে বদলে গেল। ঝলমলে জামালপুর শহরের সড়কগুলো। বিদ্যুৎ এলো দোকানপাটে।
কিন্তু সাধারণ মানুষের বাড়িঘর?
সে অধ্যায় আরো পরে।
Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *