জনজীবনতথ্যস্মৃতিকথা

বায়ান্নোর অগ্নিগর্ভকালে জন্মেছি উত্তাল জামালপুরে- আতা সরকার

দেখা হয় নাই ভাষা আন্দোলনের দিনগুলো। তার উত্তাপ কি অনুভব করেছি মাতৃগর্ভে?
আব্বা সরকারি চাকুরে। জামালপুর শহরের এক মেসে থাকেন। আম্মা আমার তিন ভাই আর দু’বোনকে নিয়ে থাকেন বকসীগঞ্জের এক গাঁয়ে সরকারবাড়িতে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ যথোপযুক্ত মানুষ করার স্বপ্ন নিয়ে সবাইকে সঙ্গে করে এক মামাকে গাইড বানিয়ে হাজির হলেন আব্বার মেসবাড়িতে।
অগত্যা আব্বাকে একটা বাসা ভাড়া নিতেই হলো। কাচারিপাড়ায়।
মা তখন আবারো গর্ভবতী। ভেতরে শুয়ে শুয়ে আমিই হাতপা ছুঁড়ছি। গুতোগুতি খেলছি।
জামালপুর শহর তখন তাঁতানো। পুরো দেশটার সাথে তাল মিলিয়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। নূরুল আমিনের কল্লা চাই। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দিব না।
শহর উত্তাল। প্রতিনিয়ত মিছিল। শোভাযাত্রা। সভা সমাবেশ। পুলিশের সাথে হাঙ্গামা। গ্রেপ্তার।
বড়ো ভাই তখন স্কুলে পড়েন। আব্বার চিন্তা তাঁকে নিয়ে। আর আম্মার চিন্তা পেটের ভেতর আরেক দাঙ্গাবাজ আমাকে নিয়ে।
ফেব্রুয়ারি মার্চ পেরিয়ে জুনের ১৭ তারিখে জগতের আলো দেহে লাগিয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
তখন থেকে বিশ বছর আগে আরো একজন এমন জুনের ১৪ তারিখে এই জামালপুর শহরে তাঁর নানার বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে। কবি হাসান হাফিজুর রহমান। সেসময়কার জামালপুর মহকুমার ইসলামপুর থানার কুলকান্দি গ্রামে তাঁর পৈত্রিক নিবাস। তাঁর কথা প্রসঙ্গক্রমে পরে হবে।
১৯৪৮ সাল। ঢাকার এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন: পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। সাথে সাথে প্রতিবাদ উঠলো: নো। না।
তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়লো পুরো বাংলায়। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে। সেই ঢেউ এসে লাগলো বাংলার উত্তর প্রান্তে গারো পাহাড়ের পাদদেশে জামালপুর মহকুমায়। বিশেষ করে তরুণ যুবা মহলে।
এরই প্রতিক্রিয়ায় জামালপুর শহরের অদূরে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে আলোকিত শহর শেরপুরে গঠিত হয় ভাষা কমিটি। আনিসুর রহমান হোন এর আহ্বায়ক।
১৪ আগস্ট ১৯৪৮।। পাকিস্তান দিবসে জি কে স্কুলে রায় বাহাদুর সত্যেনের সভাপতিত্বে ছাত্র-সমাবেশ হয়। জামালপুরের স্কুলছাত্র সৈয়দ আব্দুস সোবহান এখানে একটা প্রবন্ধ পড়েন, যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল: ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।
এ সমাবেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী সোচ্চারে করা হয়।
এর কদিন পর সৈয়দ সোবহানের রাজনীতিসচেতন বড় ভাই সেসময়কার স্কুলছাত্র সৈয়দ আব্দুস সাত্তারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সাথে বগুড়া কলেজের এক ছাত্রকেও। তাঁকে পুলিশী হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনের পর এক মাসের ডিটেনশন দিয়ে জামালপুর সাবজেলে পাঠানো হয়।
এদিকে সৈয়দ আব্দুস সাত্তার ও সৈয়দ আব্দুস সোবহানসহ কয়েকজন ছাত্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে স্কুল থেকে জোরপূর্বক টিসি দেয়া হয়।
পরবর্তীতে সৈয়দ আব্দুস সাত্তার এলাকার খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হয়েছিলেন এবং সৈয়দ আব্দুস সোবহান এলাকার খ্যাতিমান আইনজীবী ও রাজনীতিক।
১৯৫২।। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবীতে পুরো দেশটাই উত্তপ্ত ও উত্তাল।
ফেব্রুয়ারির শুরুতেই জামালপুরে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা তৈয়ব আলী আহমদকে সভাপতি, জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজের অধ্যাপক জহুরুল ইসলামকে সম্পাদক, আশেক মাহমুদ কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সুজাত আলী মিয়াকে (পরে তিনি কলেজের প্রিন্সিপ্যালও হয়েছিলেন) কোষাধ্যক্ষ এবং আখতারুজ্জামান মতি মিয়া ( পরবর্তীতে সমবায় প্রেসের ম্যানেজার) ও আশেক মাহমুদ কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আব্দুস সোবহানকে যুগ্মসম্পাদক করে একটা কমিটি গঠিত হলো।
কমিটির সাথে নানা ভাবে যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁরা হলেন: জর্জিস খান, বাদল, ছাত্রনেতা ফজলুর রহমান, সরকারী বিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দীন, মোখলেসুর রহমান, মোজাফফর, সিংহজানি স্কুলের ছাত্র কাদের, কুদ্দুস, রহমান, আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্র আব্দুল আউয়াল, আব্দুর রহমান, রেজাউল করিম, আনোয়ার, বখতিয়ার হোসেন, সৈয়দ ইমামুর রশীদ, শহরের বিভিন্ন পাড়া ও এলাকার মজিবর রহমান, আনিসুজ্জামান, শাহেদ আলী মিয়া, যমুনা আলী মন্ডল, সৈয়দ আলী মন্ডল, আব্দুল গফুর, কুদ্দুস মল্লিক, কালু মিয়া, গেদা মিয়া, মফিউদ্দৌলা, জবেদ, কালু (ছনকান্দা), সামাদ মন্ডল, ময়েনউদ্দিন, যুবনেতা ক্ষিতীশ তালুকদার, বালিকা বিদ্যালয়ের জান্নাত আরা, মতিয়া চৌধুরী, রওশন আরা, দেলোয়ারা প্রমুখ।
ছাত্রীদের মধ্যে মতিয়া চৌধুরীর কথা বিশেষ ভাবে বলতে হয়, যিনি পরবর্তীকালে অগ্নিকন্যা হিসেবে খ্যাত। তিনি তখন জামালপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তেন। তাঁর বাবা পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন, পোস্টিং ছিল জামালপুরে। মতিয়া চৌধুরীর বিপ্লবী ভূমিকার পরিচয় তখন থেকেই। পারিবারিক বাধা ও নিষেধ উপেক্ষা করে ছাত্রীদের মধ্যে আন্দোলনে তিনি দুঃসাহসিক নেতৃত্ব দিয়েছেন।
জামালপুরে ভাষা আন্দোলনে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁরা হলেন: হাতেম আলী তালুকদার, আলী আহমদ, সৈয়দ আব্দুস শরীফ, আব্দুল করিম, ওস্তাদ ফজলুল হক, আশরাফ উদ্দীন, আব্দুল গণি, রেহান আলী ও আবু বকর সিদ্দিক।
আন্দোলনে যাঁরা বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেছেন, প্রেরণা ও উদ্দীপনা যুগিয়েছেন তাঁরা হলেন: তাছির উদ্দিন আহমদ মোক্তার, হায়দর আলী মল্লিক, কফিল উদ্দীন মোক্তার, গিয়াসউদ্দীন আহমদ, ডা. মুনিরউদ্দীন আহম্মদ, সামছোদ্দোহা মোক্তার, আশেক মাহমুদ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক নূরুল হক ও দর্শনের অধ্যাপক নাছির উদ্দীন সরকার।
২০ ফেব্রুয়ারি’৫২।। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবীতে জামালপুর শহরে চারপাশ থেকে মিছিল আসতে শুরু করে। সারাদিন মিছিলে মিছিলে শহর সয়লাব হয়ে যায়।
২১ ফেব্রুয়ারি।। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবীতে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক।
ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া। শহরে আাংশিক ধর্মঘট।
স্কুল কলেজগুলোতে পূর্ণ ধর্মঘট।
আখতারুজ্জামান মতি, দিদারুল আলম খুররম, সৈয়দ আব্দুস সোবহান, আলী আসাদ কালো খোকা ও ওস্তাদ ফজলুল হকের বিরুদ্ধে পুলিশের হুলিয়া জারি।
মেলান্দহ: ছাত্রদের মিছিলে পুলিশী হামলা। প্রতিবাদে ডা. মুহসিনের নেতৃত্বে প্রতিবাদ সভা ও মিছিল।
বিকালে ঢাকায় গুলিবর্ষণ ও মেলান্দহের ঘটনার প্রতিবাদে জামালপুর শহরে মিছিল।
২২ফেব্রুয়ারি।। জামালপুর শহর মিছিলের শহর।
নান্দিনা, দিঘপাইতসহ আশপাশের গ্রাম ও এলাকা থেকে ছাত্র জনতার মিছিল দলে দলে শহরে আগমণ। বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ। শ্লোগানে শ্লোগানে প্রতিবাদের মুখরতা। সকলের কালো ব্যাজ ধারণ।
সারা মহকুমায় পূর্ণ হরতাল।
সকাল ১১টায় শহরের বকুলতলা মোড়ের মিছিল থেকে দিদারুল আলম খুররম গ্রেপ্তার।
জামালপুর মহকুমার থানা থানায় ধর্মঘট। হরতাল। মিছিল। শোভাযাত্রা। সভা। গণজমায়েত।
রাতেই গ্রেপ্তার হলেন আখতারুজ্জামান মতি, আলী আসাদ কালো খোকা, ওস্তাদ ফজলুল হক, সাদা খোকন।
২১-২৪ ফেব্রুয়ারি।। সর্বত্র ধর্মঘট। সরিষাবাড়িতে টানা হরতাল।
২৫ ফেব্রুয়ারির ছাত্র-জনতার জমায়েতকে কেন্দ্র করে থানায় থানায় সভা। শোভাযাত্রা। মিছিল।
২৫ ফেব্রুয়ারি।। শহরের গোপাল দত্ত মাঠ ও হিন্দু বোর্ডিং মাঠে বিশাল সমাবেশ।
সর্বত্র খন্ড খন্ড মিছিল।
ডেপুটি সিভিল সার্জন অফিস, সমাজ কল্যাণ দপ্তর ও মহকুমা প্রশাসকের অফিস ঘেরাও।
শিক্ষকরাও রাস্তায় নেমে আসেন।
২৭ ফেব্রুয়ারি।। কলেজ টিচার্স কাউন্সিলের সভা। সভাপতিত্ব করেন আশেক মাহমুদ কলেজের অধ্যক্ষ এ এইচ এম কুদ্দুস। তিনি দেশখ্যাত নাট্যকার ও বলিষ্ঠ অভিনেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনের পিতা।
সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানানো হয়।
১ মার্চ।। দেওয়ানগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে বিশাল জনসভা। সভাপতিত্ব করেন নাদের হোসেন।
৩ মার্চ।। এর আগ পর্যন্ত সর্বত্র প্রতিদিন সভা সমাবেশ শোভাযাত্রা মিছিল।
কৃষ্ণ দিবস ঘোষণা। স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট।
৫ মার্চ।। সিংহজানি মসজিদের সামনে জননেতা তৈয়ব আলীর সভাপতিত্বে জনসভা।
গোয়েন্দা সংস্থা তৈয়ব আলীকে সভা থেকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলে সভাপতির বক্তব্য দেয়ার পর তিনি সুকৌশলে সরে যান।
১৯৫৩। ২১ ফেরুয়ারি।। জামালপুরের কৃতী সন্তান ভাষা সংগ্রামী কবি হাসান হাফিজুর রহমানের
সম্পাদনায় ঢাকা থেকে ‘ একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে দৃষ্টান্তমূলক অসাধারণ সংকলন প্রকাশিত।
সংকলনটিকে তৎকালীন সরকার নিষিদ্ধ করে।♣
তথ্যসূত্র:
১. সৈয়দ আবদুস সোবহান: আমি কি ভুলিতে পারি।
২. এম. এ. বার্ণিক: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।
Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *