গোপালের মিষ্টি, খানের চা, সাধুর পান- রমরমা বকুলতলা : আতা সরকার
গোপালের মিষ্টি মুখে দিয়েই আমার মিষ্টি-সুখ বোধহয় শুরু। জামালপুর টাউনের মধ্যমণি সেই বকুলতলার এপাশে গোপালের মিষ্টির দোকান। ওপাষে খানের চা। আর এদিকে বকুলতলার কোল ঘেঁষে সাধুর পানের দোকান। সকালেই খানিক বাদেই এসে ঠিক বকুলকলার গোলচক্করে এসে বসবে রঘু নাপিত। চারপাশ চুলে চুলে সয়লাব করে দেবে।
কাহিনীটা গত শতকের। পঞ্চাশ-ষাটের দশক। সে সময়ই অই অজ মফঃস্বল শহরে আমার জন্ম ও বালক-বেলা। তখনো শহরের রাস্তা পাকা হয়নি, ইট বিছানো। কোনো কোনো রাস্তা ইট-খোয়ার। অলি-গলি মাটিতে বাঁধানো। পরে আমাদের চোখের সামনেই স্টেশন টু পাথালিয়ার মেইন রোডটা পাক্কা করা হয়। সন্ধ্যায় মিউনিসিপ্যালিটির লোকরা রাস্তার মেড়ে মোড়ে ল্যাম্পপোস্টের বাতিতে কেরোসিন ঢেলে সলতেয় সারারাতের জন্য আগুন জ্বালিয়ে যায়।
তখন বাসায়-বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন মানেই গোপালের মিষ্টি। আরো একটু যত্ন করতে চাইলে খড়ির চুলোয পোলাও কোরমা চড়িয়ে দাও। ঘরে তো পালা মুরগী রয়েছেই।
আর অতিথি যখন বাসার ফটক পেরিয়ে অন্দরে ঢোকেন, তখনো তাদের হাতেও থাকে মিষ্টির প্যাকেট নয়, হাড়ি। মিষ্টির জন্য কাগজের প্যাকেটের চল তখনো হয়নি, মাটির হাড়িই সম্বল। আমরা যারা মিষ্টি কিনে আনতে যেতাম, ঘর থেকে আনার পাত্র সাথে করেই নিয়ে যেতাম, তখন মিষ্টির মাপ ছিল সের হিসেবে।
খানের চায়ের দোকান আমাদের নিত্যই চোখে পড়তো ভোরবেলায়, তখনো অন্ধকার পুরো কাটে না। আমরা বন্ধু-বান্ধবরা কম্পিটিশন দিয়ে ভোরে উঠে প্রাতঃভ্রমণে বেরুতাম। বকুলতলা ছিল কমন, বকুল ফুল কুড়নোর নেশায়। সে সময দেখতাম, খানের চাযের দোকানের আধেক পাট খোলা। দোকানের সামনে রাস্তার পাশে মাটির তৈরি কয়লার চুলো। তাতে পাথুরে কয়লা ঢুকিয়ে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা চলছে। আগুন জ্বালানোর আগের প্রক্রিয়া দেখা হয়নি। আমরা নিত্য দেখতে পাই, হাতপাখা দিয়ে চুলোর মুখে খুব করে হাওয়া দেয়া হচ্ছে। আর চুলো গড়িয়ে ধুমছে ধূঁয়ো উপরে গলগল করে উড়ছে। তারপর চুলোয় গণগণে আগুন। সেই যে চুলো জ্বললো, তা জ্বলতেই থাকে গভীর রাত অবধি। আর তার উপর কেতলির পর কেতলি চাপতেই থাকে।
না, খানের চায়ের টেস্ট নেয়া হয়নি কখনো। তার দোকানের কোনো খাবারও চেখে দেখা হয়নি। বালক আমাদের জন্য নিষিদ্ধ।
তবে খানের চায়ের দোকানে ঢোকা হয়েছে, দেখা হয়েছে তার ভেতরমহলের দৃশ্যপট। কয়েকবারই। আব্বা সকালে বাজার করেন। প্রায় প্রতিদিনই। কখনো সখনো আমাকে সাথে নেন। কেন নেন, তা আজ পর্যন্ত আমার জানা হয়নি। কারণ বাজারে আমার কোনো ভূমিকাই থাকতো না। এমনকি বাজারের ব্যাগটাও খুব একটা বইতে হয়নি।
বাজারের আগ দিয়ে তিনি কখনো কখনো খানের চায়ের দোকানে বসতেন। চায়ের সাথে সাথে াড্ডার অন্যদের সাথে কথা বলতেন। এভাবেই দেখা খানের চায়ের দোকান।
সাধুর পানের দোকান আমাকে খুব টানতো। নানান ধরনের পানের চাইতেো পুরো দোকানে সাজানো ছিল পানের বাহারি মসলা। চুন।খয়ের। জরদা। এ আকর্ষণ তো পানখোরদের আমার আকর্ষণ তার দোকানের চারপাশে সাজানো বাঁধাই করা বিভিন্ন দেব-দেবীর ছবি। ভারতবর্ষের নেতাদের ছবি– গান্ধী, নেহেরু, সুভাষ বসু থেকে শুরু করে জিন্নাহ পর্যন্ত। পরে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকেও সাধুর দোকান থেকেই চিনতে পারি।
সাধু মাঝে মাঝে কিন্তু সত্যি সত্যি সাধু হয়ে যায়। চলে যায় তার সাধন-ক্ষেত্রে।
সাধুর পানের দোকানের সামনেই বকুল গাছের তলায় গোলচক্করে চুল ছাঁটার দাঁড়ি কামানোর কাঁচি ক্ষুর নরুনসহ হাতিয়ার পত্তর নিয়ে বসে রঘু নাপিত। কাস্টোমারের বসার জন্য ছোট জলচৌকি।ামরা মাথা পেতে দিই চুল ছাঁটা জন্য। বড়রা মাথার চুল ছাঁটার পাশাপাশি মুখমন্ডল পেতে দেয় দাঁড়ি কামিয়ে নেয়ার জন্য।
বাটিছাঁটা দিয়ে শুরু। বয়সের তালে তালে নানা স্টাইলের চর্চা চলে মাথার উপর দিয়ে।
আমি অবশ্য বেশিদিন রঘু নাপতের খপ্পর থাকিনি। আমি তখন সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের ছাত্র। স্কুলের সামনেই নাপিতের ওয়েল ডেকোরেটেড দোকান। ফ্যাশন কাটিংএর জন্য তখন সেখানেই যাতায়াত। রিভলবিং চেয়রে বসে সেখানেই আয়েশে চুলের পরিচর্যা।
ভোরে বকুলতলায় ফুল কুড়োতে এসে দেখি, বকুল ফুল আর ছাঁটা চুলের মাখামাখি।