ব্রহ্মপুত্রের বুকে: জামালপুর থেকে বকশীগঞ্জ- আতা সরকার
ধবল রাত। ফকফকা জ্যোছনা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চরাচর। চাঁদকে সাথে নিয়ে চাঁদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে গয়না নাও। কূল নাই কিনারা নাই ব্রহ্মপুত্র নদ উথাল পাথাল ঢেউ। সেই মাতাল ঢেউকে ফালা ফালা করে কেটে কেটে হাওয়ায় উড়ছে চ্ছপাৎ চ্ছপাৎ আওয়াজ। চার বা আট মাল্লা বৈঠায় বৈঠায় দেখাচ্ছে তাদের বাহুর মাংসল পেশীর কসরত। আর হাল ধরে আছে যে কাপ্তান নাইয়া, সে মনের ফূর্তিতে গলা চড়িয়ে সুর তুলছে। এ এক স্বপ্নাতুর নৈশ যাত্রা জামালপুর টু বকসীগঞ্জ। জামালপুরের গুদারাঘাট থেকে বকসীগঞ্জের কাঁঠালতলীর ঘাট। বর্ষায় পানি থাকলে আমাদের বাড়ির কাছে ঝোরা পর্যন্ত। ফিরতিতেও একই পথ।
বাহন গয়না নৌকা। যেখান থেকেই হোক না কেন, জামালপুর বা বকসীগঞ্জ, যাত্রা সেই রাতেই। পৌঁছে যাওয়া সকালে। নৌকায় এক আয়েসী ঘুমের আড়মোড়া ভাঙ্গার পর।
বকসীগঞ্জ পৈত্রিক বাড়ি। পিতার চাকরির সুবাদে জামালপুর শহরে থাকা। ছুটিছাটায় ধান কাটায় ফসল তোলার মৌসুমে বাড়িতে সপরিবারে যাতায়াত।
জামালপুর থেকে বকসীগঞ্জের দূরত্ব সোজাসাপ্টা সড়কে অর্থাৎ নদী পেরিয়ে ঝগড়ার চর হয়ে খুব সম্ভব আঠারো মাইল। বড়ো ভাই স্কুল কলেজে পড়াকালে সে যুগের বিখ্যাত রেলি কোম্পানির সাইকেলে প্যাডেল মেরেই চলে যেতেন।
গল্পটা গত শতকের পঞ্চাশ আর ষাটের দশকের। আমার শৈশব আর বাল্যের।
ঐটুকু পথই তখন দূরপাল্লার যাত্রা। আর সে যাত্রার বাহনগুলোও আদ্দিকালের। ঢাকা শহরে বাস চলে বলে শুনেছি, কিন্তু দেখা হয় নাই। মোটর যানের মধ্যে দেখেছি এসডিও সাহেবের জিপ গাড়ি। সে গাড়ির দরজায় আবার দুই হাতের ছাপ মারা। এক হাতায় পাকিস্তানের ফ্ল্যাগের আস্তিন, আরেক হাতে মার্কিন ফ্ল্যাগের আস্তিন। কে জানে, এমন জিপও মার্কিনী অনুদান কিনা।
আর রাতে চলে ট্রাক। মালামাল সওদাপাতি পরিবহনের জন্য। সেই সাইকেলের রাস্তায়।
আমাদের যাতায়াত ট্রেনে নৌকায় সাইকেলে গরুর গাড়িতে, এমনকি পদযুগলেও।
রবীন্দ্রনাথ বজরা বোট নিয়ে পদ্মা ঘুরতেন। সেখানে বসেই তাঁর পূর্ববঙ্গের সৌন্দর্য দেখা।
আমাদের বজরা নেই। বোটও দেখিনি। নদী পারাপারের সুবাদে চড়া হয়েছে নৌকায়। বড় নৌকাও। এমনকি গয়না নৌকাতেও।
গয়না নৌকা মানে গয়না দিয়ে সাজানো নৌকা নয়। বেশ বড় সাইজের যাত্রীবাহী নৌকা। যাত্রী নিয়ে বর্ষাকালে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে। জামালপুর থেকে সন্ধ্যার পর যাত্রী নিয়ে নৌকা ছাড়ে। সকালে গিয়ে বকসীগঞ্জ পৌঁছে। একই ঘটনা ওদিকেও। বকসীগঞ্জ থেকে সন্ধ্যার পর ছেড়ে নৌকা যাত্রী নিয়ে সকালে জামালপুর পৌঁছে।
ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ জনের যাতায়াত। তারা জামালপুর গুদারাঘাটে এসে নৌকায় চড়ে। কেউ কেউ নৌকায় উঠে পরনের পোশাক বদলে ঘরের কাপড়চোপড় পরে নেয়। তারপর রাতের ঘুমের জন্য শোয়ার আয়োজন। যাত্রীরা নৌকার কাঠের চওড়া পাটাতনে যার যার বিছানা বালিশ পেতে নেয়, ঠিক লঞ্চ বা স্টিমারের ডেকের মতো। পাশাপাশি দুটো সারি। মাঝখানে হামাগুড়ি দিয়ে যাতায়াতের প্যাসেজ। মেয়েরা থাকলে এর মাঝ দিয়ে বা এক কোণায় শাড়ি বা চাদরের ঘের দিয়ে পর্দা করে নেয়, লঞ্চ বা স্টিমারের কেবিনের মতো।
মাথার উপর বিশাল ছৈ থাকলেও হাঁটাচলার উপযোগী নয়। নৌকার ভেতর চলাফেরা করতে হয় হাঁটু গেড়ে বা হামাগুড়ি দিয়েই।
বকসীগঞ্জের ঘাটগুলো তেমন পরিচিত নয়। তবে জামালপুরের সব ঘাট না জানলেও বেশ কয়েকটায় বিস্তর আনাগোনা। কাচারি ঘাট কোর্টকাছারির কাছাকাছি। এসডিওর বাংলোর কাছাকাছি দেওয়ানপাড়ার ওপাশে গুদারা ঘাট। এ ঘাটের কাছেধারেই জয়দেবদের দইচিড়ামিষ্টির দোকান। জয়দেব ঘোষবাড়ির ছেলে আমাদের সহপাঠী। ঘাটে যাওয়ার পথে কেন জানি চাতক পাখির মতো ওদের দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এই গুদারা ঘাট থেকেই গয়না নৌকা ছাড়ে।
বাজারের উল্টোদিকে কালিবাড়ি ঘাট। যাওয়ার পথে কালিমন্দির। তারপর চাঁপাতলা ঘাট। এরপর শেরপুরের ফেরি পারাপারের ঘাট।
কখনো কোনো বিকেলে ব্রহ্মপুত্রের পাড় ঘেঁষে এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম– কয়েক বন্ধু মিলে গল্পগুজব করতে করতে।
গয়না নৌকায় চাঁদনী রাত দেখার মতো। আর পাগলপারা হয়ে দেখতাম নদবক্ষে অরুণোদয়।
কিন্তু বকসীগঞ্জে কাঁঠালতলী ঘাটে নৌকা থেকে নামানামি হতো বলে ওটাকে খানিক চেনা ছিল। ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী দশানী নাম নিয়ে মোড় ফিরেছে বকসীগঞ্জের দিকে। তারই এক ঘাট কাঁঠালতলী।
বর্ষায় পানি যখন আরো বাড়ে তখন দশানীর যোগ ঘটে ঐ এলাকার বিশাল বিলজমি ঝোরার সাথে। সেটা আমাদের সরকারবাড়ির কাছাকাছি। এ বিলে আমাদেরও জমিজমা রয়েছে। তখন গয়না নৌকা ও অন্য নৌকাগুলো সেখানেও এসে ভিড়ে।
আবার কখনো পরিবার থেকে একটা নৌকা রিজার্ভ করা হয়। সকালে নাস্তাপানি করে ছেঅলা নৌকায় ওটা হয়। চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে, নদীর দুপাশের লোকদের হাঁকাহাঁকি শুনতে শুনতে, দাঁড়ের আওয়াজ পানির চ্ছলাৎ চ্ছলাৎ শুণতে শুণতে, হাত বাড়িয়ে পা ডুবিয়ে নদের স্পর্শ নিতে নিতে এমন ভ্রমণের মজাই আলাদা।
আমাদের নৌকা যেন নায়র নৌকা। ক্ষেতখামারে লোকরা কাজ করতে করতে নৌকা দেখে হেঁকে ওঠ: কই যায়?
: পাখিমারা জনি সরকারের বাড়ি।
কালপ্রবাহে গন্তব্যের নাম পাল্টায়: কলিমুদ্দি সরকারের বাড়ি। ময়েন মাস্টারের বাড়ি। মকবুল কেরানীর বাড়ি। এমপি বাড়ি। আইজি বাড়ি।
ঘাটে নামলেই বাড়ির ছৈতোলা গরুর গাড়ি হাজির। যতোটুকু পথ, পর্দাঘেরা গোযানে বাড়িতে প্রবেশ।
বাড়িতে যাওয়ার আরেক বাহন ট্রেন। সেটা সরাসরি বকসীগঞ্জ নয়। ভায়া হয়ে।
বকসীগঞ্জ তখন দেওয়ানগঞ্জ থানার আওতায়। সেখানে সুগারমিল থাকায় সেসময় জায়গাটার গুরুত্বও অনেক। তার উপর জংশন স্টেশন। পরের স্টেশনই বাহাদুরাবাদ ঘাট– উত্তর বঙ্গে যাতায়াতের পারাপারের ঘাট।
ট্রেনে দেওয়ানগঞ্জ স্টেশন। সেখানে নেমেই হোটেলে খাওয়া। বাইরের এ খাওয়াটা আমার জন্য খুব উপাদেয়। মজার বাইরের খাওয়া বলে কথা।
দেওয়ানগঞ্জ থেকে বকসীগঞ্জ সাত মাইল পথ।
এখানেও ব্রহ্মপুত্র। বর্ষাকালে নোকায় চড়ে সেই কাঁঠালতলী ঘাট, না হয় ঝোরায়।
আর শুকনো মওসুমে অন্য ব্যবস্থা। ভরসা তখন পদযুগল। দেওয়ানগঞ্জ সদর থেকে নদী পেরুতে হয় হাঁটুজল ভেঙে। তারপর নদীর পাড় ঘেঁষে দীর্ঘ পথ। চরের পথ। তারপরই একদিকে নালার মতো নদের জলের শোভা, আরেকদিকে সবুজ সোনালি ফসলের বাহার। দেখতে দেখতে পথ চলতি লোকদের সাথে কথা বলতে বলতে ক্ষেতে কর্মরত লোকদের সাথে ভাব বিনিময় করতে করতে কখন যে বকসীগঞ্জে হাজির হতাম, টেরই পেতাম না।
কখনো কখনো পানির তেষ্টায় কোনো গৃহস্থ বাড়িতে থামলে কূয়ো থেকে সদ্য তোলা পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়া হয়। অতিথি নারায়ণ। খালি মুখে শুধুই পানি দিলে অকল্যাণ। এসে পড়ে নাস্তা মুড়িমুড়কি। তার যোগাড় না থাকলেও পানির সাৎে কাসার বাটিতে করে বাতাসা নাহয় গুড়ের টুকরো।
পরিবার নিয়ে এই পথে বাড়ি এলে আব্বা ট্রেনের আস্তো একটা কামরা রিজার্ভ করে নিতেন। সেটা থার্ড ক্লাস বা ইন্টার ক্লাস হতেও মানা নেই।
বর্ষাকালে ট্রেন থেকে নেমে দেওয়ানগঞ্জ ঘাট। সেখানে নৌকা রিজার্ভ। কাঁঠালতলী, নাহয় ঝোরা। আবার গোযান।
শুকনো মওসুমে দেওয়ানগঞ্জ স্টেশন থেকেই বাড়ি থেকে এসে অপেক্ষারত গরুরগাড়ি। তারপর পুরো পথে ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ। এ যেন রেলগাড়ির যান্ত্রিক ঝিকিরঝিক আওয়াজের একঘেয়ে আদিকালীন প্রতিবাদ।
তবু তো গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আনন্দ।
Please follow and like us: