জনজীবন

ভারতীয় উপমহাদেশে যেভাবে এল ট্রেন!

নয়ন আসাদ: ট্রেন । নগর পেরিয়ে কখনো দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠের মাঝখান দিয়ে, কখনো গ্রামের বুক চিরে ঝকাঝক শব্দ তুলে তুমুল গতিতে চলা এই বাহন ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবলভাবে জনপ্রিয়। কিন্তু কিভাবে ভারতীয় ‍উপমহাদেশে প্রচলন ঘটেছিল রেলগাড়ির। ঢাকা জামালপুর রেলপথে যেতে যেতে সেই গল্প শোনাব আপনাদের।

আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন ভারতীয় উপমহাদেশে রেল এসেছিল ব্রিটিশদের হাত ধরে। আমাদের চলাচলের সুবিধার কথা চিন্তা করে নয় এখানে তাদের বাণিজ্যিক, ব্যবসায়িক এবং সামরিক স্বার্থই ছিল প্রধাণ কারণ। তবে কারন যেটাই হোক ব্রিটিশদের এই উদ্যোগ বড় রকমের সুবিধা দিয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের জনজীবনে।

ভারতীয় উপমহাদেশে বানিজ্যিক রেলপথ বসানোর চিন্তা করা হয়েছিল ১৮৩২ সালের দিকে। তবে তারপরের এক দশক থমকে ছিল সেই চিন্তা। এর মাঝে ১৮৩৭ সালের দিকে নির্মাণসামগ্রী পরিবহনে মাদ্রাজে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল স্বল্পপাল্লার রেলগাড়ি। তবে বানিজ্যিক রেল চালু হতে লেগেছিল আরো বেশ কিছু সময়।

১৮৪৪ সালে লর্ড হেনরি হার্ডিঞ্জ ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হলে তিনি এই বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহন করেন এবং যেহেতু ব্রিটিশ সরকার নিজেরা করছেনা তাই তিনি বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানকে তাদের ব্যবসায়িক সুবিধা অনুযায়ী রেলপথ নির্মাণের অনুমতি প্রদান করেন।

এর প্রেক্ষিতে ১৮৪৭ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে, ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে কোম্পানি (জি . আই. পি. আর.) গঠনের প্রস্তাব দিয়ে বিল পেশ করা হয়, কিন্তু তৎকালীন ভারতে শাসন করতে থাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিলের কয়েকটি ধারা নিয়ে আপত্তি তোলায় বিলটি খারিজ হয়ে যায়। ১৮৪৮ সালে লর্ড ডালহৌসি ভারতের গভর্নর জেনারেল পদে অভিষিক্ত হলে ১৮৪৯ সালের আগস্টে পাশ হয়ে যায় সেই বিল এবং ঐ বছরের ১৭ই অগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সাক্ষর হয়ে যায় জি.আই.পি.আর.-এর।

ইংরেজ গভর্নর লর্ড ডালহৌসি রেলপথ নির্মাণের কাজে গতি আনেন। কলকাতা, বম্বে এবং মাদ্রাজ বন্দরকে রেলপথে যুক্ত করার পরিকল্পনা করেন তিনি। ডালহৌসির ঐতিহাসিক রেলওয়ে মিনিট বিখ্যাত হয়ে আছে এখনো যেখানে রেলপথ নির্মাণ কোম্পানিগুলোর সাথে ব্রিটিশ সরকারের বেশ কিছু শর্ত আর পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করা হয়।

প্রথম পর্যায়ে বেসরকারিভাবে গ্যারান্টিপ্রথায় রেলপথ নির্মাণ শুরু হয়। গ্যারান্টি প্রথা হচ্ছে রেলপথ নির্মাণকারী কোম্পানিদের সাথে সরকারের লাভ নিশ্চিত করার চুক্তি। যার মেয়াদ ছিল শত বছর। শর্তগুলো ছিল অনেকটা এমন যেহেতু বেসরকারি কোম্পানিগুলো ঝুকি নিয়ে বিনিয়োগ করবে তাই তাদেরকে ৫ শতাংশ লভ্যাংশ সরকার নিশ্চিত করবে, কোম্পানিগুলো বিনামুল্যৈ রেলরাস্তার জমি পাবে আর ৯৯ বছর পর এই রেলপথগুলো সরকারের হাত চলে যাবে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও রেলপয়ে কোম্পানি তৈরি করে পশ্চিমবাংলার হাওড়া থেকে রানীগঞ্জ শহর পর্যন্ত প্রায় ১২১ মাইল রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব নেয়। রাণীগঞ্জ তখন কয়লা খনির জন্য বিখ্যাত ছিল।

গ্যারান্টি প্রথার অধীনে বোম্বে থেকে থানে পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিসসুলার কোম্পানি।

বম্বে এবং থানের মধ্যে রেললাইন পাতার কাজ শেষ হয় ১৮৫২ সালের নভেম্বর মাসে। ১৮ ই নভেম্বর রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার ও পেনিনসুলার কোম্পানির পরিচালকরা নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চালানো হয়। এবং এর পরের বছর ১৮৫৩ সালের ১৬ই এপ্রিল বম্বের বরি বন্দর থেকে ৪০০ জন যাত্রী নিয়ে থানে স্টেশনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় প্রথম বানিজ্যিক ট্রেন। ২১ ‍ মাইলের এই ঐতিহাসিক যাত্রা ছিল ইতিহাসের এক বড় পালাবদলের। ১৪ কোচ বিশিষ্ট ভারতের প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেন প্রায় ৪৫ মিনিট বাদে যখন গন্তব্যে পৌঁছায় তখন থানে স্টেশনে উৎসবের আমেজ। সাহিব, সিন্ধ এবং সুলতান নামের তিনটি বাষ্পচালিত ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছিল প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেনে।

ভারতের প্রথম রেলযাত্রাকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছিল বিপুল উদ্দীপনার। এমনকি এর ফলে বম্বে সরকার সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিল সেইদিন। দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে কোম্পানিও প্রস্তুতিতে কোনও ত্রুটি রাখেনি সেদিন। , ইংল্যান্ড থেকে আনানো হয়েছিল আটটি ইঞ্জিন আর শেষ পর্যন্ত তাদের ভেতর থেকে তিনটিকে বেঝে নেওয়া হয়েছিল। ৪০০ যাত্রীকে থানে স্টেশনে অভ্যর্থনাতেও ব্যাপক সমারোহে কোনও কার্পণ্য করেনি জি.আই.পি.আর.। মরসুমের শ্রেষ্ঠ খাদ্যসামগ্রীর ঢালাও সমারোহে, সেদিন ব্যাপক খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

১৮৫৪ সালে হাওরা থেকে হুগলি রেলপথ নির্মাণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এরকম করে রেলপথ নির্মিত থাকে। তবে ঘটনা ঘটে অন্য জায়গায়।

যেহেতু সরকার কর্তৃক লাভের গ্যারান্টি ছিল কোম্পানিগুলো বিপুল অংকের খরচ দেখিয়ে লোকসানে দেখাতে থাকে। আর সরকারি কোষাগার থেকে সেই বিপুল টাকা কোম্পানিগুলো নিয়ে যেতে থাকে। এ নিয়ে ব্যাপক নিন্দা শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার গ্যারান্টি প্রথা বাদ দিয়ে সরকারি অর্থায়নে রেলপথ নির্মানের উদ্যেগ নেয়। কিন্তু সরকারি উদ্যেগে তেমন অগ্রগতি হয়নি রেলব্যবস্থার। এর এক দশক পরে পুনরায় গ্যারান্টি প্রথা সংশোধন করে আবার গ্যারান্টি প্রথাতেই বেসরকারি উদ্যেগেই ফিরে যায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার।

আজ আর বেশি দূর যাচ্ছি না। শুধু এটুকু জনিয়ে রাখে ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে ত্যাগ করার সময় ৬৫ হাজার কিলোমিটার রেলরাস্তা বসানো হয়ে গিয়েছিল। এখন যা দুনিয়ার বৃহত্তম একটি রেল নেটওয়ার্ক!

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *