ফেরিঘাট- জামালপুরের সোনালী স্মৃতির আখ্যান
নয়ন আসাদ: জামালপুর। অবহেলিত এক জেলার নাম। নানা সময়েই এই জেলায় নানা কর্মযজ্ঞ স্বপ্ন দেখিয়েছে একটি সমৃদ্ধ জামালপুরের। কিন্তু ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে থেকে গেছে শুধুই দীর্ঘশ্বাস! ফেরিঘাট এবং রেলফেরি এমনই কিছু দীর্ঘশ্বাসের নাম। যমুনার কারণে বিচ্ছিন্ন দেশের দুই পাড় এবং বর্তমান ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগের ধারণা আমূল পাল্টে দিয়েছিল এইসব ফেরি ও রেলফেরি। কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর হয়ে উঠেছিল দুই পাড়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া এবং এদিকে ঢাকা, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম এবং সিলেট, গৌহাটি এবং বার্মার সাথে যোগাযোগের যে বিশাল নেটওয়ার্ক তার প্রাণ ছিল জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ও বাহাদুরাবাদ ঘাট।
সে সময়ে নারায়নগঞ্জ- গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ-চাদপুর, বাহাদুরাবাদ-তিস্তামুখ এবং জগন্নাথগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ এই চারটি পথে স্টিমার ও ফেরি চালানোর মাধ্যমেই যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়েছিল কলকাতার সংগে পুর্ব বঙ্গ ও আসামের যোগাযোগ স্থাপন। যা সেসময় পরিচালনা করত ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে ও আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে।
বাহাদুরাবাদ ঘাট। বহুল পরিচিত, আলোচিত এই ঘাটটির অবস্থান দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায়। একসময় শুধুমাত্র দেশেই নয়, বাহাদুরাবাদ ঘাটের পরিচিতি ছিল বিশ্বব্যাপী। কিন্তু বাহাদুুরাবাদ ঘাট এখন শুধুই স্মৃতি। ঘাটের প্রয়োজনীয়তা, জনপ্রিয়তা আর উপযোগীতা হারিয়েছে অনেক আগেই। সাম্প্রতিককালে নির্মিত বিশালাকার কোলাহলহীন ঘাট জানান দিচ্ছে শুধুই হাহাকার। অথচ আমাদের ছিল একটি বহুদূর এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু এখন যমুনার নিত্য ভাঙ্গা গড়ার খেলায় এক অভাগীনি উপজেলা দেওয়ানগঞ্জ। যার ঘাড়ের কাছে যমুনা প্রতিনিয়ত ফেলছে ভাঙ্গনের নি:শ্বাস! যোগাযোগ ব্যবস্থা, চিকিৎসা ও শিক্ষায় যোজন যোজন পিছিয়ে থেকে বলতে পারি শুধু স্বপ্নের কথা, থমকে যাওয়া সম্ভাবনার কথা। যমুনা, ব্রক্ষপুত্র, জিনজিরাম, দশানী প্রভৃতি নদী বিধৌত দেওয়ানগঞ্জ ইতিহাসের আয়নায় ধারণ করে আছে এক বিশাল অপূর্ণতা আর দীর্ঘশ্বাস!
অথচ যদি পেছন ফিরে তাকাই তবে ইতিহাসের আয়নায় ভেসে উঠে একরাশ সমৃদ্ধতা। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে তিস্তামুখ ঘাটের সাথে বাহাদুরাবাদ ঘাটের নৌ-যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত হয় রেলওয়ে মেরিন বিভাগ। যার প্রথম সুপরিনটেডেন্ট ছিলেন লর্ড বারিংটন নামক এক দক্ষ ইংরেজ কর্মকর্তা। বারিংটনের সময় ‘দরবার’ ও ‘প্রিন্সেস মেরি’ নামক কয়লা চালিত জলযানে পার হত যাত্রী ও ওয়াগন।
বেশ পরে বিশ শতকের দিকে আধুনিকায়ন হয়ে আসে ডিজেলচালিত যাত্রীবাহী স্টিমার ও ওয়াগনবাহী টাগবোট।
যমুনার বুক চিরে একসময় তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে রেলফেরী। তিস্তা আর একতা ট্রেন ভিড়ত নদীর দুই পাড়ে। হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ঘাটটি পরিণত হয় উত্তরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের মূল কেন্দ্র। ঘাটসহ এই অঞ্চলের নিরাপত্তায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাহাদুরাবাদ নৌ-থানা। বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেস নামে ট্রেনও চালু হয় যা চলত চট্টগ্রাম থেকে ঘাট পর্যন্ত। বাহাদুরাবাদ ঘাট অকার্যকর হয়ে ইতিহাসে স্থান পাওয়ার আগে ঘাট ও ঘাটকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বপ্ন দেখিয়েছিল অযুত সম্ভাবনার। অভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে ঘাটটির গুরুত্ব প্রাণচঞ্চল করেছিল এই উপজেলাকে।
স্বাধীনতার পর বাহাদুরাবাদ ঘাট পুনরায় চালু হলেও ঘাটটি প্রথম ধাক্কা খায় নব্বইয়ের দশকে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায়। নাব্যতা হ্রাসে চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ায় তিস্তামুখ ঘাট থেকে সরিয়ে ওইপারের ঘাট স্থানান্তরিত হয় বালাসীঘাটে। বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হলে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সক্রিয় থাকার পর অনেকটা গুরুত্ব হারায় এই ঘাটকেন্দ্রিক যোগাযোগ। সেই সাথে উপজেলা হিসেবে গুরুত্ব হারায় দেওয়ানগঞ্জ। বছরের পর বছর এই নৌ-পথে সেবা দেওয়া জলযান বাহাদুর শাহ, মীর জুমলা, ঈসা খাঁ, তিতুমীর ও বৈরাম খাঁ নামগুলো পরিণত হয় শুধুই ইতিহাসে।