মুভি রিভিউ: পদ্মাবত- কল্পিত ইতিহাসের উদ্দেশ্যমূলক চিত্রায়ন
পদ্মাবত সিনেমা নিয়ে এক লাইনে লিখতে গেলে বলতে হবে এটি একটি শতভাগ রাজপুত বন্দনার সিনেমা । এমনিতে পদ্মাবতী চরিত্র যে পুরোপুরি বানোয়াট এবং কাল্পনিক সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোনও সন্দেহ নেই। আর পদ্মাবত সিনেমা পদ্মাবতীর গল্প যিনি ফেঁদেছিলেন মধ্যযুগের সুফি কবি মালিক মোহাম্মদ জায়সীর পদ্মাবতী মহাকাব্যের কাহিনীকেও বিকৃত করা হয়েছে চরমভাবে । যদিও সিনেমার ডিসক্লেইমারে পরিচালক সঞ্জয়লীলা বানসালী বলেছেন জায়সীর কাহিনীই তিনি গ্রহন করেছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে করা যায় বানসালী সিনেমার শুটিংয়ের সময় রাজপুতদের চর থাপ্পর খেয়ে সিনেমার কাহিনী রাজপুত বন্দনায় পরিবর্তন করেছেন সেই সাথে খিলজি ও পদ্মাবতীর প্রেম কাহিনীর গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় মানস উস্কে দিয়ে নিজের সিনেমার মার্কেটিংও করেছেন ।
পদ্মাবতী সিনেমার শুরুতেই আলাউদ্দীন খিলজিকে বহুগামী এবং কামুক চরিত্রে উপস্থাপনা করা হয়েছে । আলাউদ্দীন খিলজি একটি ঐতিহাসিক চরিত্র এবং ভারতীয় ইতিহাসের অংশ সেই সাথে যিনি দিল্লীতে বাজারদর নিয়ন্ত্রন এবং বিস্তৃত রাজ্যজয়ের জন্য বিখ্যাত । তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ অছে কিন্তু তার চরিত্র উপস্থাপনে পরিচালক ইতিহাস কিংবা সত্যের আশ্রয় গ্রহন করেন নি । নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে রীতিমতো বীভৎস, বহুগামী, সমকামী, নিষ্ঠুর, মিথ্যাবাদী, বেঈমান হিসেবে চিত্রিত করেছেন যেখানে চিতোরের রাজপুত রাজা রাওয়াল রতন সিংকে মনের মাধুরি মিশিয়ে বীর, মার্জিত সুশাসক হিসেবে উপস্থাপনা করেছেন । এই সিনেমার ট্রেলার প্রকাশিত হওয়ার পর রাজপুত করনি সেনা এই বলে আপত্তি প্রকাশ করেছিল যে রাজপুত রানির প্রকাশ্যে এরকম নাচে অংশগ্রহণ তাদের আভিজাত্য বিরোধী । সেখানে আলাউদ্দীন খিলজির এমন চিত্রায়ন যে ভালো উদ্যেশ্যে নয় তা বলা খুবই যুক্তিসঙ্গত । এবং যেখানে নামাযের দৃশ্যও রয়েছে।
জায়সীর কাহিনীতে রতন সেন ছিলেন আগে থেকেই বিবাহিত এবং রতন সেনের প্রথম স্ত্রী নাগমতির সঙ্গে পদ্মাবতীর বিবাদ শুরু হলে বিবাদ মেটাতে গিয়ে রতন সেন গলদঘর্ম হয়ে পড়েন। এসময়ই রাঘব চেতন নামীয় ব্রাহ্মণ পদ্মাবতীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এটা জানতে পেরে রতন সেন রাঘবকে হত্যার আদেশ দেন। কিন্তু রাঘব গোপনে পালিয়ে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির দরবারে চলে যান। পালানোর সময় পদ্মাবতী রাঘবকে একটি চুড়িও উপহার দেন ।
কিন্তু পদ্মাবতী সিনেমায় এমন কিছুর চিত্রায়ন নেই । বরং রাঘবকে একপেশে ভিলেন হিসেবেই চিত্রিত করা হয়েছে পদ্মাবতী চরিত্র কে মহৎ করার জন্য ।
জায়সীর গল্পে রতন সেন যখন চিতোর ছিলেন না সেসময় পদ্মাবতীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন কুম্ভালনার শাসক দেবপাল। আর রতন সেন পরে তা জানতে পেরে দেবপালের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন । এবং এই যুদ্ধে মারা পড়েন দেবপাল ও রতন সেন দুজনেই ।
আর এই সময় রতন সেনের মৃত্যুর খবর শুনে রতন সেনের দুই স্ত্রী পদ্মাবতী এবং নাগমতি দুজনেই সতীত্ব রক্ষায় জওহর প্রথা অনুসরন করে আগুনে জীবন্ত পুড়ে মৃত্যুবরন করেন।
জায়সির গল্পে আলাউদ্দিন খিলজি পুনরায় চিতোর দূর্গ অবরোধ করেন রতন সেন এবং পদ্মাবতীর মৃত্যুর আরো পরে । নিশ্চিত পরাজয় জেনে রাজপ্রাসাদে সকল নারীরা বিশাল অগ্নিকুণ্ড বানিয়ে তাতে ঝাপ দিয়ে আত্মাহুতি দেন । আর পুরুষরা সব যুদ্ধ করে মারা যান।
কিন্তু সিনেমায় খিলজির আক্রমনই পদ্মাবতীকে আগুনে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করে এমন ঘটনার অবতারনা করেছেন বানসালী ।
সবকিছুর পরে বানসালীর পদ্মাবত সিনেমার মাধ্যমে বানসালীর উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে রাজপুতরাও সিনেমার বিরোধিতা থেকে বানসালীর ভক্ত বনে গেছে । বানসালীও মুভির আয় নিয়ে তৃপ্ত হওয়ার কথা । কিন্তু তিনি সিনেমাকে যে উদ্দ্যেশে ব্যবহার করেছেন তা অব্যাহত থাকলে ভালো কিছু যে আশা করা যায়না তা নিশ্চিত ।